বঙ্গোপসাগর থেকে কুয়াকাটা সৈকতে একের পর এক ভেসে আসছে মৃত ডলফিন। এ সব ডলফিনের নমুনা সংগ্রহ না করেই দেওয়া হচ্ছে মাটি চাপা। মৃত্যুর সঠিক কারণ নিশ্চিত করতে পারছে না কেউ। যার ফলে দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সমুদ্রের নীল অর্থনীতি, উপকূলের পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা গবেষকেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ভেসে আসছে মৃত ডলফিন, তিমি, কচ্ছপ ও রাজ কাঁকড়া। সামুদ্রিক এ সব জলজ প্রাণীর মৃতদেহগুলো জোয়ারের স্রোতে ভেসে এসে সৈকতের বালিয়াড়িতে আটকা পড়ছে। সৈকতের পরিবেশ-প্রতিবেশীর রক্ষার জন্য বন বিভাগের বিট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় মৃত জলজ প্রাণীগুলো বালুচাপা দিচ্ছেন। তবে, নমুনা সংগ্রহ করার কথা বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। যার ফলে কিভাবে ডলফিনগুলো মারা যাচ্ছে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। অনুমান করে জেলেদের জালে পেঁচিয়ে মারা গেছে বলা হয়। যার সঠিক কোন প্রমাণ মিলছে না।
সূত্র জানিয়েছে, কুয়াকাটা সৈকতে চলতি বছরে ৪টি গলিত ও অর্ধগলিত ডলফিন ও দুটি কচ্ছপ ভেসে এসেছে। এর আগে, ২০২১ সালে ২৪টি ও ২০২২ সালে ১৯টি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছে। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অন্তত শতাধিক গলিত ও অর্ধগলিত শুশুক ও ইরাবতী প্রজাতির ডলফিন ভেসে আসে। এ ছাড়াও প্রতিবছর মৃত তিমি, কচ্ছপ ও রাজ কাঁকড়া ভেসে আসছে। এর আগে, ভেসে আসা মৃত ডলফিনগুলো সমুদ্রের বালিয়াড়িতে আটকে থাকত। সৈকতেই পচে গলে জোয়ারের পানিতে মিশে যেত। কোন কোন সময় শিয়াল ও কুকুর খেয়ে ফেলতো। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় এগুলো বালুচাপা দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ও দক্ষ জনবল না থাকায় নমুনা সংগ্রহ করতে পারছে না বনবিভাগ।
এ প্রসঙ্গে বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে জোয়ারের স্রোতে ভেসে আসে গলিত অর্ধগলিত ডলফিন, কচ্ছপ। এগুলো দ্রুত অপসারণ করে বালু চাপা না দিলে বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়ায়। আগত পর্যটকরা অস্বস্তিতে ভোগেন। তাই গোটা সমুদ্র সৈকত এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার জন্য আমি খবর পাওয়া মাত্রই মাঠকর্মীদের পাঠিয়ে এগুলো মাটি চাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করি। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের কাছে নমুনা সংগ্রহ করার মতো কোনো কিছু নেই।
গত ১১ মে বেলা ১১টার দিকে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন সৈকতে দুটি অর্ধগলিত ডলফিন ভেসে আসে। ইরাবতী প্রজাতির ডলফিন দুটির দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৮ ও ৩ ফুট ছিল। দুপুর ১২টার দিকে বন বিভাগের কর্মকর্তারা ডলফিন দুটি বালুচাপা দেওয়া হয়েছে গণমাধ্যমকে জানায়। কিন্তু বিকেল ৩টার দিকে গিয়েও ডলফিন দুটি সমুদ্র সৈকতে দেখতে পাওয়া যায়। আধা ঘণ্টা পর বন বিভাগের কুয়াকাটা বিট কর্মকর্তা মো. সিরাজুল ইসলাম ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি ব্লু গার্ডের সদস্যদের খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে বাসা থেকে শাহিনুর বেগম ও ফুলভানু নামের দুইজন ব্লু গার্ডের সদস্য ডেকে আনেন। পরে বিকেল সাড়ে ৪টায় নমুনা সংগ্রহ না করেই ডলফিন দুটি সৈকতে বালুচাপা দেওয়া হয়।
সকাল থেকে সৈকতের ওই পয়েন্টে মাছ ধরছিলেন চিনিমতি ভানু নামের এক মহিলা। এই প্রতিবেদক কথা বলেন তার সঙ্গে। তিনি বলেন, বেলা ১১টার দিকে ডলফিন দুটি সৈকতের বালুতে আটকে পড়ে। ঘণ্টাখানেক পর স্থানীয় দুইজন সাংবাদিক এসে ছবি তুলে চলে গেছেন। এ ছাড়া কেউ আসেনি। এখন বিট অফিসার ব্লু গার্ডের সদস্যরা এসেছে। আমি কাউকে নমুনা সংগ্রহ করতে দেখিনি।
এর আগে, গত ৪ মে গভীর রাতে কুয়াকাটা পর্যটন পার্ক সংলগ্ন সৈকতে ৯ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা একটি মৃত ইরাবতী ডলফিন ভেসে এসেছিল। পরদিন সকালে সেটির নমুনা সংগ্রহ না করে সৈকতে মাটি চাপা দেওয়া হয়।
স্থানীয় জেলে ছালেক মোল্লা বলেন, আমার বাড়ি কুয়াকাটা সৈকতের কাছাকাছি। আমরা সবসময় সাগর পাড়েই থাকি। বিভিন্ন সময়ে সৈকতে ডলফিন, তিমি, কচ্ছপ, কাঁকড়া ভেসে আসে। তবে, কোনোদিন কাউকে নমুনা সংগ্রহ করতে দেখি নাই। সৈকতে ওঠার পর ফরেস্টাররা (বন প্রহরী) এসে স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে বালু চাপা দিতে দেখেছি। আমি নিজেও ফরেস্টারদের সাহায্য করেছি।
এদিকে, ২০১৮ সালে গঠিত হয় কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটি। সৈকতে মৃত ডলফিন ভেসে আসার পর কমিটির সদস্যরা খবর পেলে বন বিভাগকে জানায়। ডলফিন রক্ষায় এই কমিটির কাজ কি তা এখনও স্পষ্ট নয়। ডলফিন কেন মারা যাচ্ছে তা নিশ্চিত হতে পারেনি এই কমিটি।
কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, ২০১৮ সালে কমিটি গঠনের পর থেকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেও ডলফিন মারা যাওয়ার কারণ নিশ্চিত হতে পারছি না। এই কমিটি আপাতত কোথাও মৃত ডলফিন উঠলে সেটির প্রজাতি নির্ণয় করে এবং সাইজ পরিমাপ করে বালু চাপা দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অবহিত করছে।
সমুদ্রের নীল অর্থনীতি, উপকূলের পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-২, বাংলাদেশ প্রকল্পের সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি বলেন, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জলজ প্রাণীর মৃত্যুর সঠিক কারণ নিশ্চিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। মৃত্যুর সঠিক কারণ নিশ্চিত হতে পারলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এভাবে চলতে থাকলে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। যা আমাদের জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়।