এই যেন ইটভাটার মহাৎসব। কখনো কৃষিতে আবার কখনও জনবসতিতে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্যা ইটভাটা গড়ে উঠেছে, সম্প্রতি সরজমিনে
চট্টগ্রামের শস্যভান্ডার রাঙ্গুনিয়া গুমাইবিলে কৃষি জমিতে গড়ে উঠেছে এই রকম ৬৯টি ইটভাটা। তাছাড়া রাজানগর, ইসলামপুর, লালানগর, নিচিন্তাপুর, চন্দ্রঘোনা, বেতাগী, পোমরা ও সরফভাটা ইউনিয়নের ফসলি জমি ও সংরক্ষিত বনের ভেতরেও গড়ে উঠেছে ইটভাটা।
এমনকি কোদালা চা-বাগানের পাশে কর্ণফুলী নদীর তীর কেটেও গড়েতোলা ইটভাটা আপাতত সরকার পতনের পর বন্ধ রয়েছে। ইটভাটায় ইট প্রস্তুত করার জন্য ভাটা মালিকেরা কৃষকের জমি থেকে মাটি কেটে সেখানে ব্যবহার করছেন। খননযন্ত্র বা স্কেভেটর দিয়ে ১০-৩০ ফুট উচ্চতায় গভীর করে চলছে মাটি কাটার উৎসব। এতে প্রান্তিক কৃষকরা হারাচ্ছেন মাটির উর্বরতা। একশ্রেণীর মাটি ব্যবসায়ীরা কৃষকদের প্রলোভন দেখিয়ে ফসিল জমি নষ্ঠ করাচ্ছে।
ইট প্রস্তত ও ভাটা স্থাপন নিযন্ত্রন আইনের ২০১৩এর মাটি ব্যবহার নিয়ন্ত্রন ও হ্রাস করণে ৫(১)ধারায় উল্লেখ্য, কোনো ব্যাক্তি ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে কৃষিজমি, পাহাড় বা টিলার মাটি কেটে ব্যবহার করা যাবেনা। আইনের ১৫ধারায় বলা আছে, যিনি এই আইনের ৫ না মানেন তাকে ২বছরের কারাদন্ডে অনধিক ২লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু এই আইন প্রয়োগ না থাকায়, মাটি ব্যবসায়ীরা উপরিভাগ মাটি টপস সয়েল নষ্ঠ করার কারনে ফসল উৎপাদনের বিপর্যয় ঘটছে।
রাঙ্গুনিয়ায় এবছর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সবমিলিয়ে ভাটা চালু আছে ৬৯টি। সব’কটির নেই কোন লাইসেন্স। নামে মাত্র আছে পরিবেশ ছাড়পত্র ৬৬টির। তারপরেও ৩টির তাও নেই। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা আছে লাইসেন্স বিহীন ইটভাটা চালাইলে দুই ২বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা। ইটভাটার জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামুলক এবং নিদিষ্ট এলাকায় ইটভাটার জায়গা ও ভাটার সংখ্যা নির্ধারিত। কিন্তু বেশির ভাগই ইটভাটা গড়ে উঠেছে লোকালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাহাড় পাদদেশে ও বনের ভিতরে। যাহা পরিবেশ আইন সম্পূর্ণ লঙ্গন করে। এসব ইটভাটার কারণে দূর্ষিত হচ্ছে আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ।
হুমকীর মুখে জীববৈচিত্র। সরফভাটা কর্ণফুলী ব্রিক্ স ওয়ার্কস( KBW) ইট পুড়া হচ্ছে বন থেকে সংগৃহীত সম্পূর্ণ জ্বালানী কাঠ দিয়ে। ইউএনওর সাথে সখ্যতা আছে এই মালিকের পার্টনার সরফভাটা যুবদলের স্থানীয় এক নেতার।
গত বিজয় দিবসের ইউএনও ব্রিকফিল্ড থেকে গড়প্রতি চাঁদা ২৫ হাজার টাকা নিয়েছেন এই নেতার মাধ্যমে। নেতা নিজে স্বীকার করেছে এই প্রতিবেদকের কাছে। একই কথা স্বীকার করেছে পাশাপাশি আরও একটি ব্রিকফিল্ডের মালিক। এই নেতা নাকি বিশেষ কাজের দায়িত্ব দিয়ে থাকেন এবং ইউএনও’র সাথে কিছু ছবিও দেখান। এই নেতার ব্রিকফিল্ডের ম্যানেজারও স্বীকার করে বলেন একই কথা। প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই নাকি জ্বালানি হিসেবে সম্পূর্ণ বনের কাঠ দিয়ে পুড়ছেন এই ইটভাটায়।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ৬৯টি ইটভাটা যার কোনটির বৈধ লাইসেন্স নেই। ফসলি জমি বা পাহাড়ি ভুমি নষ্ট করে তৈরি হওয়া এসব ইটভাটাগুলোর আশেপাশে রয়েছে জনবসতি ও অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব ইটভাটা গুলো ফসলি জমির মাটি কেটে নিচ্ছে এবং ইট পোড়ানোর সময় নির্গত কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ দূর্ষিত হওয়ার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। প্রশাসনের সম্পৃক্ততায় এসব অনুমোদনহীন ইটভাটা গুলোর কার্যক্রম বন্ধের কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন জানায়, সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসন নামে মাত্র দু’একটি অভিযান পরিচালনা করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। একইভাবে সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার উত্তরাংশে স্বনির্ভর, ইসলামপুর ও বেতাগী ইউনিয়নের পাশের জমি থেকে স্কেভেটর দ্বারা শুরু হয়েছে মাটিকাটা। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শস্যভান্ডারখ্যাত গুমাইবিলের ফসলি জমিও ধ্বংস হচ্ছে ইটভাটা ও দালান গৃহ ইমারত নিমার্ণের কারনে। এ বিলের উত্তর-পূর্বাংশে হোসনাবাদ ইউনিয়নের নিশ্চিন্তাপুর, কানুরখীল, আন্ন সিকদারপাড়া, দক্ষিণে মরিয়মনগর ও চন্দ্রঘোনা-কদমতলী ইউনিয়ন, কাপ্তাই রোড ও পশ্চিমে ডিসি রোড সংলগ্ন ফসিল জমি ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে এবং হচ্ছে অর্ধ শতাধিক আবাসন ও বাণিজ্যিক দালান।
রাঙ্গুনিয়া মডেল থানা থেকে ৫শ গজের মধ্যে গুমাই বিলের ফসলি জমিতে গত এক সাপ্তাহ ধরে চলছে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ। প্রশাসনের নাগের ডগায় কাপ্তাই সড়ক সংলগ্ন সৈয়দবাড়ি এলাকায়
কুলকুরমাই বিলে এভবন নির্মাণে ইউএনও’র নিরব ভূমিকা সাধারণ জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃস্টি হয়েছে। অথচ ভূমি মন্ত্রনালয় থেকে বাংলাদেশের বৃহৎতম গুমাই বিলের ফসলি জমিতে গৃহ নির্মাণে সরকারের সম্পূর্ণ বিধি নিষেধ রয়েছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বন্ধ থাকলেও বর্তমান ইউএনও গৃহ নিমার্ণে মৌখিকভাবে অনুমতিও দিয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা রাঙ্গুনিয়া উপজেলা মডেল শাখা, পৌরসভা শাখা ও রাঙ্গুনিয়া প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ উদ্বেগ প্রকাশের পর গত ৭ জানুয়ারি রাঙ্গুনিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তখন কৃষি জমির টপ সয়েল কাটার অপরাধে অপরাধী ইসমাঈল সিকদারকে ‘বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন’ ২০১০ মূলে ৫০ হাজার টাকা অর্থ দণ্ড প্রদান করা হয়। আইন অনুযায়ী, কৃষিজমিতে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে, বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটার এবং ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়কের অন্তত আধা কিলোমিটারের মধ্যে কোন ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। এই আইন অমান্য করলে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড, অন্তত ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। এই আইনকে উপেক্ষা করেই চলছে ইটভাটা ও আবাসনের রমরমা ব্যবসা। মরিয়ম নগর চৌমুহনীর অদুরে বৌদ্ধ মহাধাতূ চৈত্র বিহারের পাশ ঘেষে তৈরী হচ্ছে ফসলি জমির উপর নির্মিত হচ্ছে আরও একটি বহুতল ভবন।
অবৈধ ইটভাটার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন ফয়সাল জানান, চট্টগ্রামের সবকটি উপজেলায় অধিকাংশই কোন না কোন কারণে অবৈধ। ইটভাটাগুলো পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. মোজাহিদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে এই বিষয়ে অবগত করা হলে তিনি জানান যে, তিনি বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কড়া নির্দেশ দেবেন।